ছয়
নির্দিষ্ট দিনে আলেয়া চলে গেল। এর মাঝে দুই দিনে শাহাজাদার সাথে আলেয়ার আরো চারবার দেখা হয় মামার বাড়ীতে। মামা মামী ওদের ভালোবাসার কথাটা জেনে যায়। শাহেদ পাঠান আপত্তি করে না।
“ তোমরা শুধু সম্ভ্রানত্ম বংশের নও,লোকে তোমাদের ভালো লোক বলে জানে, মান্য করে। একসময় তোমাদের কথা সবার মুখে মুখে ঘুরত। তোমার দাদাকে দেখেছি, তোমার বাবাকে দেখেছি। তাদের কথা আমরা আজো সবাই মনে করি। লোকে আজকাল অবশ্য বংশ-বুনিয়াদ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, টাকা পয়সা বা অন্যকিছু নিয়ে ভাবে,কিন্তু আমি ভাবি না। তোমাদের বিত্ত বৈভব আজ হয়ত তেমনটা নেই কিন্তু তোমাদের যা আছে তা এ অঞ্চলে কার আছে? আলেয়াকে এজন্য আমি প্রশংসা করি,ঠিক কাজটাই সে করেছে। দেখতে সুন্দর সম্ভ্রানত্ম বংশের একজনকে সে পছন্দ করেছে এটা বেশ ভালো। কিন্তু তোমার বাড়ীর লোকদের মতামত বিশেষ করে তোমার মা আর বড় সৈয়দের মতামতটা নেয়া উচিত। তুমি কি বল? ” স্ত্রী ছোহেলী বেগমকে শাহেদ পাঠান প্রশ্ন করে।
আলেয়ার মামী ছোহেলী বেগম পাঠান বংশের মেয়ে। কিন্তু বংশ নিয়ে সে ভাবে না। তার মনের কথাটা সে বলে।
“ বংশ বুনিয়াদ নিয়ে লোকে আজকাল তেমনটা আর ভাবে না, শিড়্গা দীড়্গা টাকা পয়সা এসব নিয়ে বেশি ভাবে। শাহাজাদা ভালো ছেলে,এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আলেয়ার বাবা ছোলেমন কি তাকে মেনে নিবে? শাহাজাদা তো চাকরি বা কোনো কর্ম করে না। শুধু বংশ আর দেখতে ভালো হলেই কি সব হবে? ” আলেয়ার সামনে এসব কথা হচ্ছিল। আলেয়া ক্ষুব্ধ হল। সে কিছু বলতে চাইল কিন্তু কোথা থেকে একটা বাধা এল, সে কিছু বলতে পারল না! শাহাজাদা নিরবে বসে আছে। স্ত্রীর কথায় শাহেদ পাঠান বিব্রত হয়, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়।
“ আলেয়া এযুগের মেয়ে। ঢাকায় জন্মেছে, সেখানে মানুষ হয়েছে। তার পছন্দ অপছন্দটা হচ্ছে সব। এখানে তোমার আমার বা ছোলেমনের বলার কি আছে? আর ছেলে তো মাশালস্নাহ্ সবদিক থেকে ভালো। লেখাপড়া করেছে, চাকরি করে না,করবে। সময় হলে একটা চাকরি সে ঠিক জুটিয়ে নিবে। চাকরি পেলে না হয় বিয়েটা হবে। তুমি কি বল বাবা? ” শাহেদ পাঠান A¯^w¯Í‡Z পড়েছেন, শাহাজাদা তা বুঝতে পারে। পরিবেশটা হালকা করার জন্যে সে বলে,
“ মামী হয়ত ঠিক বলেছেন? তবে এ নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনি ঠিক বলেছেন, চাকরি পেলে পর আমি বিয়ে করব। ততদিন আলেয়া পড়াটা চালিয়ে যাক। ” শাহেদ পাঠান শাহাজাদার মুখের কথাটা লুফে নিল,
“ দেখলে তো বংশ মর্যাদার কি গুন? এমন আচরণ সম্ভ্রানত্ম বংশীয়দের কাছ থেকে ছাড়া আর কার থেকে আশা করতে পার? ” শাহাজাদা অবাক হয়। সে বুঝতে পারে না এমন কি আচরণ সে করল? ছোহেলী বেগম এবার তার ভুলটা ¯^xKvi করতে চায়।
“ আমি নিজে কিছু বলছি না,ওর বাবার কথা বলছি। এমনিতে খুঁঁত খুঁতে লোক,তার উপর আবার সেক্রেটারিয়েটে চাকুরী করে। ”
“ আরে রাখ তোমার খুঁত খুঁতে লোক আর তার চাকুরী? এরকম কত চাকুরে আছে কে তার হিসেব রাখে? কিন্তু এমন জুটি আর পাবে কোথায়? ” মামা এভাবে সরাসরি বলায় শাহাজাদা লজ্জা পায়। বাড়ী যাওয়ার জন্য উঠে দাড়িয়ে বলে, “ আমি এখন যাব। ”
মামী খেয়ে যেতে বলেন। শাহাজাদা খেতে রাজী হয় না। সে চলে এল।
আলেয়া চলে যাবার পর একমাস গত হল। শাহাজাদা বাড়ীতে কিছু বলেনি। আলেয়ার মামা নিজে বড় সৈয়দের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। শাহাজাদা তাকে অপেড়্গা করতে বলে। আজ বাড়িতে কথা বলার পর কবীরকে সাথে করে শাহাজাদা বিকেলে আলেয়ার মামার বাড়ীতে চলে এল।
শীতের দিন মামা মামী দু’জনে বাড়ির আঙ্গিনায় উনুনের ধারে বসে আগুন পোহাচ্ছেন। শাহাজাদা মামা মামীকে ছালাম দিল। মামা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছ?’ শাহাজাদা অবাক হয় আলেয়ার মামার আগের সে উৎসাহ যেন এখন আর নেই! কিন্তু সে কিছু বলে না। কবীর বলে,
“ শাহাজাদার বাড়ীর সবাই রাজী হয়েছেন। এখন সবাই মিলে ঠিক করম্নন কি ভাবে কি করবেন? ” শাহেদ পাঠানের মুখটা মস্নান হল। ভীষন হতাশা নিয়ে সে ধীরে ধীরে বলে,
“ আমি তো বাবা নিঃসনত্মান। আলেয়া শুধু আমার বোনের মেয়ে না ওকে নিজের মেয়ে ভিন্ন কিছু মনে করি না। কিন্তু যাই বল আমি তো তার বাবা না। মেয়ের বাবার মতামতটা শেষ কথা। সে রাজী না হলে আমি ভেবে কি করব? ”
শাহাজাদার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে! বাকরম্নদ্ধ হয়ে সে মামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কবীরও nZf¤^! মামী বললেন,
“ গত পরশু উনি ঢাকা থেকে ফিরেছেন। ফিরার পর থেকে ঠিকভাবে কথা বলছেন না, না বললেও আমি সব বুঝতে পারছি। আলেয়ার বাবাকে আমি চিনি। খুব বড় মুখ করে ও বলতে গিয়েছিল। আমি আর কি বলব ?” শাহাজাদা জিজ্ঞেস করে,
“ আলেয়া কি বলল? ” শাহেদ পাঠান এবার যেন বলার মত একটা কিছু পেল।
“ আলেয়া আমাকে বারবার বলেছে, বাবা যাই বলুক,মামা আমি শাহাজাদা ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না। কিন্তু ওর বাবা তো তার বসের সাথে আলেয়ার বিয়ে ঠিক করেছে?”
“ আলেয়ার বাবার বস? তার অর্থ সে তো বয়সে অনেক বড়! এমন একজনের সাথে আলেয়ার বাবা বিয়ে ঠিক করলেন? ” কবীরের কথায় পাঠান কিছুটা বিরক্ত হয়।
“ আফিস আদালত তো কিছু দেখনি? কেরানী আর বস এদের জানবে কি করে? বস হলেই যে বড় হবে এমন নয়। আলেয়ার বাবা তো কেরানী। (আলেয়ার মামার মুখটা বড় সৈয়দের মত কুঁচকে গেল না ঠিক তবে তার কন্ঠে তাচ্ছ্যিলটা স্পষ্ট ) কেরানীর উপরে অফিসাররা থাকেন। সাধারণত তারা কম বয়সের হন। তবে আলেয়ার মা বলল যার সাথে আলেয়ার বিয়ে ঠিক করেছেন সে বয়স্ক। ”
“ সে তো বয়স্ক? ” কবীরের কন্ঠে ড়্গেভের চেয়ে হতাশা বেশি। কিন্তু শাহেদ পাঠানের কন্ঠে বিরক্ত আর হতাশা,দু’টোই সমান।
“ আরে বাবা হোক না তার বয়স বেশি, সে তো একটা বড় চাকুরে? ঢাকায় থাকে, হয়ত ঢাকায় তার বাড়ী আছে নয়ত ভবিষ্যতে হবে? তার উপর সে আবার সৈয়দ বংশের...!”
‘ সৈয়দ বংশের? ’ শাহাজাদা আর কবীর একসাথে বলে উঠে। মামার কন্ঠে আবার সে হতাশা!
“এসব ছেড়ে তার বাবা অন্য কারো কথা ভাববে?”
পাত্র বড় চাকুরে! ঢাকায় বাড়ী! সৈয়দ বংশের! শাহাজাদাকে চিনত্মায় ফেলে?
“ এ তিনটাই টেক্কা! আমার প্রতিপড়্গের হাতে পড়েছে। দান জেতার জন্য এর উপরে আর কিছু নেই, সবাই তা জানে। কিন্তু আমি হার মানব না। আমার জীবনকে নিয়ে এ খেলাটা। শুধু তিনটে টেক্কা নয়, আরো একটা টেক্কা রয়েছে,তা অদৃশ্য--আলেয়ার ভালোবাসা। আর এ টেক্কাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় টেক্কা যা আমার হাতে রয়েছে। এই এক টেক্কা দিয়েই আমি তিন টেক্কাকেই মাত করব। জীবনকে নিয়ে এ জুয়া,তাসের নিয়মে সব হতে হবে এমনটা নয়, এটা ভিন্ন কিছু। খেলাটা শুরম্ন হয়েছে, হার জিত এখনো হয়নি। কিন্তু আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে কেন? বুকের উপর ভীষন ভারী শক্ত একটা কিছু যেন চেপে বসতে চাচ্ছে? দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, তারপরও একটা শিহরণ অনুভব করছি! আলেয়া আমাতে মুগ্ধ, সে আমাকে ভালোবাসে, বাজিটা তাকে নিয়ে। তাসের বাজিতে যে শিহরণ তার চেয়ে এ যেন আরো ভয়ঙ্কর, প্রবল কিছু একটা! সে বড় চাকুরে, ঢাকায় তার বাড়ী আছে বা হবে? এসব অনেকের আছে আমারো হতে পারে। এ দু’টো নয়, সে একজন সৈয়দ! এটাই আমার ভাবনার বিষয়? অবশ্য সৈয়দ হলেই যে সম্ভ্রানত্ম হবে বা আমার মত সম্ভ্রানত্ম হবে এমনটা নয়? একথাটা বড় সৈয়দের মুখে প্রায় শুনতে পাই। সে এত দেরীতে বিয়ে করবে কেন? তা আবার তার অধস্থন কারো মেয়েকে? যাকে সে বিয়ে করতে চায় সে যদি কাউকে ভালোবাসে, কারো বাকদত্তা হয় তারপর সে এমনটা করবে কেন? সৈয়দ বংশের সম্ভ্রানত্ম কেউ হলে এমনটা কখনও ভাবতে পারে না। সে কি কিছু জানে না? না জানলে তাকে জানাতে হবে। আর এখান থেকেই খেলাটা আমি শুরম্ন করব। ” যদিও ভাবানাগুলো খুব দ্রম্নত সে ভাবল কিন্তু তার চেয়ে বেশি দ্রম্নত সে নিজের উপর বিরক্ত হল।
“ না আমি তাকে কিছু বলব না, কিছু জানাব না। এটা একটা নীচ কাজ, বাজে চাল! এক সম্ভ্রানত্ম জুয়াড়ি কখনও এমন একটা বাজে চাল নিয়ে ভাবতে পারে না। কিন্তু তবু ভাবছি কেন?...নিজের উপর কি আস্থা হারিয়ে ফেলেছি,এজন্য? এটা অসম্ভব! ” শাহাজাদা কবীরকে লড়্গ্য করে বলে, “ চল আমরা কাল ঢাকায় যাই। আলেয়ার সাথে আমার দেখা হওয়াটা খুব জরম্নরী। ” কবীর নিজে কিছু ভাবে না ভাবতে চায় না। যন্ত্রের মত বলে, “ কালকেই? বেশ, তাই চল। ”
ওদের কথা শুনে মামা আঁতকে উঠেন!
“ ঢাকায় যাবে,ঢাকায় গিয়ে কি করবে? আলেয়ার দেখা পাবে কোথায়? ” মামা কি বললেন শাহাজাদা তা যেন শুনতেই পেল না। সে আবার নিজের মনে বলে উঠল “ ঢাকায় যাব, সেখানেই সব ফয়সালা হবে। আপনি আলেয়ার ঠিাকানাটা দিন। ”
মামা আর আপত্তি করেন না, নিরবে আলেয়ার ঠিকানাটা দিয়ে দেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন